নীলফামারীর গ্রামীণ জনপদে এখন কেবলই কৃষকের বুকভাঙা আর্তনাদে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। হাজার হাজার অসহায় কৃষক পরিবারকে সান্তনা দেবার এখন আর কেউ নেই। এ ক্ষতিগ্রস্থ জনপদে কোন আগন্তুকের আগমন ঘটলেই তাকে ঘিরে কৃষকের আর্তনাদ বেড়ে যাচ্ছে। না এটা কোন স্বজন হারানোর কারণে সৃষ্ট কোন দৃশ্য নয়। এ হৃদয়বিদারক দৃশ্যটি তাদের সর্বস্ব দিয়ে আবাদ করা ইরি ধান সহ অন্যান্য ফসল ও ঘরবাড়ি গত বৃহস্পতিবারের ঝড় আর শিলাবৃষ্টিতে ধংস হয়ে যাওয়ায় তাদের হৃদয় ফাটানো আর্তির বহিঃপ্রকাশ।
জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে জেলার ডোমার উপজেলার ৯ টি ইউনিয়ন, ডিমলা উপজেলার ৩ টি ও জলঢাকা উপজেলার ২ ইউনিয়নের উপর দিয়ে এক প্রলংয়করী কালবৈশাখী ঝড় আর প্রচন্ড শিলাবৃষ্টি বয়ে যায়। এ শিলাবৃষ্টি আর কালবৈশাখীর ছোবলে লন্ড ভন্ড হয়ে যায় জেলার ডোমার, ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার অর্ধশতাধিক গ্রাম। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ডোমার উপজেলার ভোগডাবুড়ি, কেতকীবাড়ি, গোমনাতী ও পাঙ্গা মটুকপুর ইউনিয়ন। এ সকল এলাকায় শুধুমাত্র জমি ছাড়া কোন কিছুই অবশিষ্ট নেই। সর্বস্ব হারিয়েছে এ এলাকার আপামর জনসাধারন। এ সকল এলাকায় কেবলই জনগনের সব হারানোর আর্তনাদ। শুধুমাত্র ডোমার উপজেলায় ধান ফসলেই ক্ষতির পরিমান ১৫০ কোটি টাকারও বেশি। সব মিলিয়ে এ উপজেলায় ৫০০ কোটি টাকারও বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন সুত্রে প্রাপ্ত তথ্য জানা যায়।
ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলায় শত কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির অনুমান করা হচ্ছে। প্রাকৃতিক এ দুর্যোগে জেলা প্রশাসন উপজেলা প্রশাসনকে ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা প্রণনয়নের দায়িত্ব দিয়েই তাদের কর্তব্য শেষ করেছেন। উপজেলা প্রশাসন তালিকা প্রণনয়নের দায়িত্ব দিয়েছে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদকে। এখানেই সীমাবদ্ধ রয়েছে সরকারী কর্মকান্ড। এ ঝড়ে গাছ চাপা, ঘর চাপা ও ফসল ধংসের দৃশ্য দেখে হার্ট এ্যাটাকে এ যাবত শিশুসহ অন্তত ৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছে অন্তত অর্ধশতাধিক। এ প্রলংকরী ঝড়ের পরেও সরকারিভাবে খোলা হয়নি কোন নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। গতকাল তিনদিন অতিবাহিত হলেও কোন প্রকার ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো হয়নি দুর্গত এলাকায়।
বৃহস্পতিবার রাতের ঝড়ে গাছ ও ঘরচাপা পড়ে মা-মেয়ে সহ নিহতেরা হলেন, জেলার ডোমার উপজেলার ভোগডাবুড়ি গ্রামের গৃহবধূ খোদেজা বেগম (৪০), কেতকিবাড়ি ইউনিয়নের আফিজার রহমান (৫৫), মৌজা গোমনাতী গ্রামের আবদুল গনি (৪০), খানপাড়া গ্রামের জমিরুল ইসলাম (১২), জলঢাকা উপজেলার পূর্ব শিমুলবাড়ি গ্রামের আশিকুর রহমান (২২), ধর্মপাল খুচিমাদা গ্রামের গৃহবধূূ সুমাইয়া আক্তার (২৮) ও তার শিশুকন্যা পরীমনি (৩ মাস), ডিমলা ও ডোমার উপজেলার বোড়াগাড়ী গ্রামের নাম না জানা দুইজন। স্থানীয়রা জানায়, ঝড়ে গাছ ভেঙে বিভিন্ন সড়কে যান চলাচল বন্ধ ছিল। রাতভর গাছ সরানোর পর গত শুক্রবার সকাল থেকে কিছু এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হলেও গতকাল পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে।
পিডিবি’র দেয়া তথ্য অনুযায়ী ডোমার ও ডিমলা উপজেলায় ১০০ কিমি বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ১১ কেভি লাইনের ২২ টি খুটি ভেঙ্গে গেছে। ২৩ হাজার ৩৮ জন গ্রাহকের মধ্য এখনো ১৭ হাজার গ্রাহক অন্ধকারে রয়েছেন। যাদের আগামি তিন দিনেও সরবরাহের আওতায় আনা যাবেনা বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পল্লী বিদ্যুতের ১৩৫২ কিলোমিটার লাইনের ৯ টি খুটি ভেঙ্গে যাওয়ায় ৫৩ হাজার গ্রাহকের সকল গ্রাহকেই অন্ধকারে রয়েছেন। গত ৩ দিনে মাত্র ৪ হাজার গ্রাহককে বিদ্যুৎ দেয়া সম্ভব হয়েছে মাত্র। এ ছাড়া ৫ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে অন্তত ২০ টি বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। স্থানীয় কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, কাল বৈশাখীতে উঠতি বোরো ধানের সর্বস্ব ক্ষতি হয়েছে। ভুট্টা, বাদাম ও মরিচ ক্ষেতেরও ক্ষতি হওয়ায় সর্বস্ব হারিয়েছে কৃষক। ভেঙ্গে গেছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি। সব হারিয়ে অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন খোলা মাঠে। বিঘা প্রতি ১ কেজি ধান উঠানোর মত ধান নেই কোন জমিতে।
ধান সহ ভুট্টা, বাদাম ও মরিচ ক্ষেতেরও ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় সর্বশান্ত কৃষক এখন হাবু ডুবু খাচ্ছেন অজানা আতংকে। বিভিন্ন ব্যাংক সহ বেসরকারী সংস্থা হতে ঋণ নিয়ে আবাদ করা কৃষকের যেখানে খাবার ধান নেই। সেখানে ঋণ পরিশোধ, আবাদ করতে গিয়ে সেচের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ, আগামি ফসল আবাদ, আজকে কি খাবে সে চালটুকুর সংস্থান, ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ, চিকিৎসা ও ঝড়ে ক্ষতি গ্রস্থ ঘড়বাড়ি কিভাবে নির্মাণ করবে সব মিলিয়ে জেলার অর্ধ শতাধিক গ্রামে এক আতংকজনক ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এ সকল সমস্যার সমাধান না করতে পারলে ক্ষুধার তাড়নায় আগামি দিনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি সহ সমাজে নেমে আসবে সামাজিক অবক্ষয় সহ বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপ। এ বছরের ২৯ শে মার্চ ডোমার ও ডিমলা উপজেলায় শিলাবৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সে সময়ের ক্ষগ্রিস্তদের তালিকা এখন পর্যন্ত তৈরী হয়নি। পায়নি ক্ষতিগ্রস্তরা সরকারী কোন ত্রান সামগ্রী। সেখানে আবারো প্রলংকরী নুতন এক ঝড় বয়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্থদের পাশে সরকার সহ কোন বেসরকারী সংস্থা গত ৩ দিনেও এগিয়ে না আসায় গ্রামীন জনপদে এক ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। যেন বিষয়টি দেখার কেউ নেই।
এ ব্যাপারে নীলফামারী জেলা প্রশাসক খালেদ রহিম জানান, গত বৃহস্পতিবার রাতে কালবৈশাখী ঝড়ে জেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা করা হচ্ছে। তালিকা হাতে পেলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে। তারপর প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহায়তার করা হবে। ডোমার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে ফাতিমা জানান, তালিকা প্রণনয়নের কাজ চলছে তবে কোন ত্রান এখনো বিতরন করা হয় নি। নীলফামারী-০১ আসনের সংসদ সদস্য ক্ষত্রিগ্রস্থ এলাকাকে দুর্গত এলাকা ঘোষনার দাবিতে গতকাল দুপুরে ডোমার উপজেলা পরিষদ হলরুমে এক প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করেন। ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় ত্রান বিতরন না করে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবিকে এলাকাবাসী তার এ দাবি করার পিছনে বিশেষ কোন মতলব আছে কিনা সেটা বিবেচনার দাবি করছেন।
ছবি: ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ ফসলের চিত্র।
কালবৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডব: নীলফামারীর গ্রামীণ জনপদে কৃষকদের বুকফাটা আর্তনাদ
Reviewed by admin
on
মে ১২, ২০১৮
Rating:
কোন মন্তব্য নেই: